আল্লাহ সুবহানাহু অয়া তা'য়ালা বলেন,
قُلۡ ہٰذِہٖ سَبِیۡلِیۡۤ اَدۡعُوۡۤا اِلَی اللّٰہِ ۟ؔ عَلٰی بَصِیۡرَۃٍ اَنَا وَ مَنِ اتَّبَعَنِیۡ ؕ وَ سُبۡحٰنَ اللّٰہِ وَ مَاۤ اَنَا مِنَ الۡمُشۡرِکِیۡنَ
বল, এটা আমার পথ। আমি জেনে-বুঝে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেই এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারাও। আর আল্লাহ পবিত্র মহান এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই ।
এই হলো সাবিল (পথ)। চমৎকার একটি শব্দ। আমি আল্লাহর পথে ডাকি চোখ কান খোলা রেখে এবং এর সাথে অবশ্যই থাকে আমার বিস্তর বিশুদ্ধ উপলব্ধি। এমন নয় যে আমি চতুর্দিক বিবেচনা না করেই কাউকে কোনো দিকে ডাকি। কল্যাণের পথে অবশ্যই জ্ঞানসহ ডাকি।
‘বাসীরা’। ‘বাসীরা’ হলো যখন কোনোকিছুর প্রতি পূর্ণাঙ্গ। আসলে, আরবী ভাষা অনুযায়ী এই মুহূর্তে আমার ‘বাসীরা’ নেই, কারণ এই রুমের জন্য রুমের ওপাশের মানুষদের আমি দেখতে পাচ্ছি না এবং তারাও আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। তাই এখানে চতুর্দিক আমার চোখের অবলোকন না থাকার কারণে আমার বাসীরা নেই। ‘বাসীরা’ মানে হলো চতুর্মুখী ও পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টি থাকা। এমনকি আংশিক ও একমুখীও দৃষ্টি ‘বাসীরা’ নয়। আল্লাহ বলেনঃ আমরা লোকদের দ্বীনের পথে ডাকি দৃষ্টি খোলা রেখে।
আমরা যাদেরকে কল্যাণের পথে ডাকি সেই পথের পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান, কলাল ও প্রজ্ঞার কথা আমাদের পূর্ণরূপে জানা। আপনারা জানেন এর মানে কী? এর মানে হলো – আমাদের পরিপূর্ণ জ্ঞান রয়েছে আমরা কেন মুসলিম।
শুধু এটা নয় যে, আলহামদুলিল্লাহ আমরা জানি যে আমরা মুসলিম। কিন্তু আমাদের চোখ-কান-জ্ঞান খোলা থাকতে হবে। কেন আমি মুসলিম? কেন আমি বলিলা ইলাহা ইল্লাল্লাহ? কেন আমি বলি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ ? কেন কুর’আন আল্লাহর কিতাব? আমার নিজের কল্যাণের জন্যই এ বিষয়ে আমার পরিষ্কার জ্ঞান থাকা জরুরী। বর্তমান বিশ্বে বহু মুসলমান রয়েছে। কিন্তু আপনি যদি তাদের জিজ্ঞেস করেন কেন তুমি মুসলিম তখন তারা বলবেঃ- কারণ আমার বাবা-মা মুসলিম। অথবা তারা বলবে, কারণ আমার জন্ম হয়েছে একটি মুসলিম দেশে। অথবা অনেকে বলবেঃ আমি অতো জানি না, কিন্তু আমার মনে হয় সবাই মুসলিম তাই আমিও মুসলিম।
ঐ প্রশ্নের বিপরীতে এগুলো কোনো যুক্তিশীল ভালো জবাব নয়। আর আমি আপনাদের এসব বলছি কারণ আমি এ বিষয়টি নিজের চোখে দেখেছি যে, প্রথাগতভাবে মুসলিম পরিবার থেকে আসা লোকেদের বলতে শুনেছি তারা বলে -আমি আসলে জানি না আমি কেন মুসলিম!
আমেরিকাতে এসে তারা ইসলাম ত্যাগ করতে শুরু করে। কারণ কেউ তাকে বলবে না যে, আস্তাগফিরুল্লাহ (আল্লাহ মাফ করুন!), সে তো মুরতাদ হয়ে গেছে। এ ভয় আমেরিকার মতো স্বাধীন একাকী দেশে নেই। তাই তারা দ্বীন ছাড়তে শুরু করে। এই কিছুদিন আগে আমি মেক্সিকো সিটিতে গিয়েছিলাম। ৩৮ মিলিয়ন মানুষ সেখানে। আমি খাওয়ার জন্য হালাল রেস্টুরেন্ট খুঁজতেছিলাম। অবশেষে সেখানে দুইটি হালাল রেস্টুরেন্টও খুঁজে পেলাম। মেক্সিকো সিটির একটি আলজেরিয়ান রেস্টুরেন্ট এ প্রবেশ করলাম। এক ভাই ১৯৭০ সাল থেকে সেখানে বসবাস করছেন। তাকে জিজ্ঞেস করলাম মুসলিমদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, ১৯৭০ এর দশকে প্রায় ১ লক্ষ জর্ডানী মুসলিম এখানে এসেছেন। এক লক্ষ বা তার চেয়েও কিছু বেশি হতে পারে সংখ্যাটি। কিন্তু বর্তমানে মেক্সিকো সিটিতে নামাজ পড়ার জন্য মাত্র একটি বা দুটি মসজিদ রয়েছে। জুমার নামাজের সময় সর্বসাকুল্যে ২০০ বা ৩০০ মুসলিম মাত্র উপস্থিত হয়। এরাই অবশিষ্ট আছে এখন। বাকিরা হারিয়ে গেছে প্রায়।
কেন তারা হারিয়ে গেছে? কারণ তারা কেন মুসলিম এই বিষয়ে জ্ঞান না দিয়েই তাদেরকে ছোট সময় থেকে লালন-পালন করা হয়েছে। তাই যখন তারা তাদের চারপাশের সমাজব্যবস্থাকে দেখল, তারা মনে করলো আমি অন্য সবার মতো হতে পারি। তারা চিন্তা করল, আমাকে কেন মুসলিম থাকতে হবে, এর কী কারণ? বিশ্বায়ন আমাদের দুনিয়াকে পরিবর্তিত করে ফেলছে। ইউটিউব আছে সবখানে। এসব মাধ্যমে আমাদের সন্তানরা, আমাদের যুবকরা এমনসব ভিডিও দেখছে যা তাদের মাঝে বিভিন্ন ধরণের বিভ্রান্তি তৈরি করছে। আপনি এটা বন্ধও করতে পারবেন না। তারা এসব যুগের বাস্তবতার সম্মুখীন হবেই। এ থেকে সচেতন করার, বিভ্রান্তি থেকে বাঁচার উত্তম উপায় হলো এ বোধ জাগিয়ে দেয়া যে, কেন আমরা মুসলিম। যতক্ষণ তাদের ‘বাসীরা’ না থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেদেরকে ও সমাজকে কিছু দিতে পারবে না।
এই আয়াতে বর্ণিত দুটি আইডিয়ার একটি আরেকটির সাথে জড়িত। একদিকে আমরা এমন মানুষ চাই যারা সমাজকে কিছু দিবে, সমাজে অবদান রাখবে। অন্যদিকে আমরা এমন মানুষ চাই যাদের এই বিষয়ে পরিষ্কার উপলব্ধি আছে - কেন তারা মুসলিম। আর যখন আপনার এই বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকবে যে কেন আপনি মুসলিম, যখন আপনার আরো থাকবে ‘বাসীরা’, তখন এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকবে না যে, আপনি অবশ্যই সমাজের সেবা করবেন। তখন আর এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না যে, আপনি আপনার সমস্ত শক্তিকে আল্লাহর দ্বীনের জন্য ব্যয় করবেন। কারণ মুসলিম হিসেবে তখন আপনার সচেতন দায়িত্ববোধ জাগরূক থাকবে।
রাসূল ﷺ বলেছেনঃ আমি আল্লাহর পথে ডাকি দৃষ্টি খোলা রেখে। আমি যে পথে ডাকি সেটা পূর্ণ সচেতন জ্ঞান নিয়েই। আমি এবং আমার অনুসারীদেরও এ ব্যাপারে পূর্ণ প্রজ্ঞা ও সচেতনতা রয়েছে। আজ আমাদের দ্বীন আলাদা। যখন মানুষ আমাকে জিজ্ঞেস করে কেন তুমি ইসলাম পালন কর? তুমি কেনই বা এইসব কাজ কর? আমরা এই জবাব দেই না, এড়িয়ে যাই বা অনেক সময় বলি 'আমি জানি না' বা অনেকে বলে, কারণ এটা আমাদের সংস্কৃতির অংশ। আমরা এ প্রশ্নের ঠিকঠাক জবাব দেই না অথচ অন্য ধর্ম এ জবাব দিতে পারে। আমরা বলিও না যে আমরা যা করি তার পিছনেও যুক্তিশীল যথেষ্ট কারন রয়েছে।
আমাদের যে বুদ্ধি রয়েছে তা তো আমাদের ব্যবহার করার কথা। আল্লাহ তো বলেছেন, কেন তোমরা চিন্তা কর না? আমাদেরকে চিন্তাশীল মানুষ হতে হবে। বিশেষ করে আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে আমরা এমন একটি মুসলিম সমাজে আছি যেখানে আমরা ধারণা করে থাকি যে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও ইতোমধ্যে জেনে গেছে যে ইসলাম সত্য। না, আজকের যুগে অন্তত এটা কল্পনা করবেন না। তাদের নিজেদেরকেই এই উপসংহারে আসতে হবে যে আসলেই তারা মুসলিম এবং কেন মুসলিম সেটাও তারাই সচেতনভাবে বলবে, জানবে। তাদেরকে এই শিক্ষা দিতে হবে যাতে তারা নিজেরাই বলতে পারে কেন তারা মুসলিম। হাঁ, নিশ্চিতভাবে এটা সত্য। তারা নিজেরাই বারবার নিজেদের ঈমানের নিশ্চয়তা দিবে। তাদের জানা উচিত কেন তারা মুসলিম... এবং এই চিন্তাশীলতার ভেতর দিয়ে মুসলিম যুবকরা শক্তিশালী হবে।
যখন মুসলিম যুবকদের থাকবে সত্যিকারের ঈমান, তখন তারা বিশ্বকে পরিবর্তন করে দেয়ার শক্তি অর্জন করবে। তখন দেখবেন এই আজকের বিশ্বকে একটি উন্নত বিশ্বে পরিবর্তন করে দেয়ার শক্তি শুধু তাদেরই হাতে থাকবে। কিন্তু যখন মুসলিম যুবকদের সত্যিকারের ঈমান থাকে না, যখন তাদের দৃঢ় বিশ্বাস থাকে না। তখন তারা হয়ে যায় সমাজের অপচয়গোষ্ঠী। তারা হয়ে যায় একটি পুরো প্রজন্মের অপচয়।
লেখকঃ নোমান আলী খান
বইঃ প্রশান্তির খোঁজে
বুকিশ পাবলিশার